অতঃপর শেষ হল ইতিহাস তৈরি করা এবং চায়ের কাপে ও টকশোর গোল টেবিলে দীর্ঘদিন আলোচনার অনুষঙ্গ রেখে যাওয়া একটি বৃহৎ আন্দোলনের। বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী শেখ হাসিনার মহান জাতীয় সংসদে একটি ঘোষণায় বাতিল হল সরকারী চাকুরী নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার।
কোটা ব্যবস্থা বাতিল হল কিন্তু রেখে গেল অনেক আলোচনা ও সমালোচনার। বাংলাদেশের সরকারী চাকুরী নিয়োগে ৫৬% কোটা ব্যবস্থার সবচেয়ে আলোচিত, স্পর্শকাতর ও আবেগের জায়গায় ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য সংরক্ষিত ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা। কোটা ব্যবস্থা বাতিলের কারনে এই ৩০% কোটাও বাতিল হয়ে গেল।
অনেকেই এটি বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি অবমাননা হিসেবে দেখছেন আবার অনেকেই টক শোর মিষ্টি আলোচনায় এই ব্যবস্থাটি বাতিলের দায়ভার দিচ্ছেন বর্তমান প্রজন্মের তরুন ছাত্র সমাজকে। আবার কেউ কেউ বলছেন বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেনা এরা শুধু সাল, তারিখ মুখুস্ত করাতেই অভ্যস্ত। আবার কেউ তো আরও একটু এগিয়ে তাদের সবাইকে “রাজাকারের বাচ্চা” বলে বসে আছেন।
সত্যিই কি তাই? বর্তমান প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কে লালন করে না। এই আন্দোলন কি তারই প্রতিফলন? নাকি সমাজ ব্যবস্থার শাসন-শোষণ এর যাঁতাকলে পিষ্ট হৃদয়ের হাহাকারের প্রতিধ্বনি এই আন্দোলন? কেউ কি সেই হাহাকারের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছেন বা চেয়েছেন? কেউ কি প্রতিরাতে এদের সপ্নের মৃত্যুর কান্না শুনতে পেয়েছেন ? দেশব্যাপী হওয়া এই আন্দোলনের দায়ভার নেয়া এই শিক্ষার্থীরা একটা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। এই সমাজটির নাম নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত। ছোটখাটো পারিবারিক ব্যবসা, চাকরি, কৃষি খামার বা প্রবাসী পিতার আয়ে এরা পড়ালেখা করে উঠে আসতে চাইছে। এদের প্রত্যেকের পেছনে অপেক্ষারত পরিবার। পরিবারের পাশে সমাজ। শিক্ষা শেষে একটা চাকরি করে পরিবারেকে অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল করাই যাদের সপ্ন । কারো আশা একটি চাকরী পেয়ে মায়ের চিকিৎসার বা বাবাকে একটু বিশ্রাম দেয়ার। কিন্তু সরকারী চাকরি এদেশে সোনার হরিণের নাম।
চব্বিশ বা পঁচিশ বছর পর্যন্ত একাডেমিক পড়াশুনা এরপর চাকরীর জন্য পড়তে পড়তে আরও দুই তিন বা চার বছর পর সেই সোনার হরিণ নামক সরকারী চাকুরীর ভাইভা দেয়ার পর চাকরী পায় না কিন্তু শুনতে পায় ওই নিয়োগেই কোটার জন্য খালি পরে আছে অনেক পদ। তখন যে যে অনুভুতি আশে সেই অনুভুতি দেখার আসলে কেউ নেই। বলে বেড়াচ্ছেন বিসিএস এ কোটার শুন্য পদ মেধা দিয়ে অনেক আগেই পূরণ করা হচ্ছে।
বলি সরকারী চাকরী মানেই কি বিসিএস। প্রতি বছর কতজন কে বিসিএস এর মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয় ভেবেছেন। সরকারী ব্যাংক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কি এটা মানা হচ্ছে। বিশ্বাস না হলে অগ্রণী, সোনালি, জনতা ব্যাংক এর শেষ নিয়োগ গুলো পর্যবেক্ষণ করুন উত্তর পেয়ে যাবেন। শুন্য পদ পূরণের প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট ঘোষণার পরেও দুটি ব্যাংক এর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, আফসোস হল কেউ পালন করেনি।
সরকারী বেসরকারি বিভিন্ন জরিপ বলে কোটার কারনে হাজার হাজার পদ খালি কিন্তু দেশের সাড়ে চার কোটি বেকারের জন্য তা নয়। আবার কেউ বলছেন কেউ সবাই সরকারী চাকরী করবে কেন, দেশে বেসরকারি খাত উন্মুক্ত হচ্ছে সেখানে কর্মসংস্থান হবে।
আরেক প্রহসনের নাম বেসরকারি চাকরী। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে যে কথা গুলো বলছেন তার বাস্তব প্রেক্ষাপট কি একবারও দেখেছেন। বেসরকারি চাকরীর কর্ম পরিবেশ, তার বেতন কাঠামো জানেন? একটা স্নাতকোত্তর ছেলের জন্য যদি বার বা পনের হাজার টাকা বেতন আর বার ঘণ্টা কর্মঘণ্টা বরাদ্দ করা হয় সেটা সেই ছেলেটার জন্য কতটা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করবেন। সস্তা দরে শ্রমিক কেনার এই চর্চা মনে হয় আপনাদের কারো দৃষ্টি সীমায় নেই। তার মধ্যে অভিজ্ঞতা নামক একটা অতিরিক্ত যোগ্যতার চাহিদা, যখন তখন চাকরী হারানোর ভয় তো আছেই।
এইরূপ পরিস্থিতিতে দাড়িয়ে সুযোগের সমতা চাওয়াটা কি সত্যি আদর্শের প্রতিপক্ষ? সত্যিই কি মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবমাননা? আমি মনে করি না। মনের ভিতর জাতির পিতার আদর্শ আর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান তরুন প্রজন্মের প্রত্যেকের আছে বলেই আমি মনে করি। সর্বোপরি আমি চাই আমার পরিবারের সেবা করতে। আমি চাই আমার দেশের সেবা করতে। আমি চাই এই দেশ হবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। দেশ হবে বৈষম্য, দারিদ্র্য ও শোষণ মুক্ত। আর এই বাংলাদেশ হলেই মনে হয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত সম্মান পাবেন। জয় হোক তারুণ্যের।
সবুজ কর্মকার
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়