বাংলাদেশ পুলিশের সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে নিয়োগপ্রাপ্ত যে সকল নবীন কর্মকর্তা কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী, সারদায় এক বছর মেয়াদী মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করতে যাচ্ছেন, ট্রেনিং চলাকালীন তাদের করণীয় – বর্জনীয় সম্পর্কে আমার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরামর্শ নিয়েই এই লেখা। অনেকেই বিভিন্নসময় সারদার ট্রেনিং সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, ইচ্ছা থাকা সত্তেও সময়ের অভাবে লিখতে পারিনি। আশা করছি, এটি আপনাদের সামান্যতম হলেও কাজে আসবে।
১. সময়নিষ্ঠাঃ খাওয়া, পিটি-প্যারেড, ক্লাস, নামাজ সবকিছুর ফল ইনেই নিয়মিতভাবে নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগে হাজির হবেন। একবার অলসদের খাতায় নাম উঠে গেলে, সারাবছর ধরে বহু সমস্যা- গঞ্জনার মুখোমুখি যে হতে হবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন। তাই সতর্ক অভ্যাস গড়ে তুলুন শুরু থেকেই।
২. ডিসিপ্লিনঃ সারদায় প্রচলিত একটি ডায়ালগ “ডিসিপ্লিন, ডিসিপ্লিন, ডিসিপ্লিন, ট্রেনিং ইজি”। ওস্তাদজী ( ফিল্ড ইন্সট্রাকটর; এএসআই পদমর্যাদার) ও সিনিয়র স্যাররা যখন যেভাবে যা বলবেন, তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন। বিদ্রোহী মনোভাব পরিহার করুন। সকল ধরনের গ্রুপিং, ইন্টারনাল পলিটিক্স হতে বিরত থাকবেন। দুষ্টলোকের সবরকমের উষ্কানি এড়িয়ে চলার মতো স্মার্ট হোন।
৩. পরিশ্রম বিমুখতার ( সারদার পরিভাষায় মগরামী) অভ্যাস থাকলে অবিলম্বে সোজা হয়ে যান। :p 😀 পিটি- প্যারেড এর সকল কাজ (as per program) যথাযথভাবে সম্পন্ন করবেন।
৩.চোখ-কান খোলা, মুখ বন্ধঃ কখনোই কোন বিষয়ে ওস্তাদজি বা সিনিয়র স্যারদের সাথে তর্কে জড়াবেন না বা কোন সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দাবি করবেন না। বিনা শর্তে তাদের কর্মকাণ্ডের উপর আস্থা রাখুন। ফলাফল ভাল হবে।
৪. ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক : আগেই বলেছি, মাঠে যারা ট্রেনিং করাবেন, তারা এএসআই পদমর্যাদার। তাই তাদের কমাণ্ড মেনে চলতে মানসিক অনীহা আসতে পারে। মনে রাখবেন, উনারা প্রিন্সিপাল স্যারের আদেশ বাস্তবায়ন করছেন মাত্র। সে অর্থে মাঠে উনারা স্যারের প্রতিনিধি। সুতরাং উনাদের আদেশ মানে প্রিন্সিপাল স্যারেরই আদেশ। আর তাছাড়া র্যাংক যা-ই হোক, তারা আমাদের শিক্ষক। একজন ছাত্র হিসেবে শিক্ষকের প্রতি প্রাপ্য সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শন করুন। ভবিষ্যতে দেখে নিব- টাইপের মানসিকতা রাখবেন না।
৫.নিরবতা: একদমই কথা বলবেন নাঃ ফাইলে, ক্লাস চলাকালীন , ডাইনিং রুম, ফল ইনে।
নিচু স্বরে কথা বলবেনঃ রুমে, এন্টিরুমে, ক্লাস রুমে ( যখন স্যার থাকবেন না)
উচ্চস্বরে কথা বা চিন্নাচিল্লি করবেনঃ কল্পনায় :p :p
৬. ব্যাটম্যানের ( রুম বয়) সাথে কখনোই খারাপ ব্যবহার, গালমন্দ, মারধর করবেন না। সুন্দর ভাষায় তাকে কাজে মনযোগী হতে বলুন, তাতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে তার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন।
৭. রুমমেটদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবেন। পছন্দ হোক বা না হোক, এই মানুষগুলোই একবছরের জন্য আপনার বিপদ আপদের সাথী। নিজে স্যাক্রিফাইস করে হলেও সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। রুমে ধূমপান ও সকল প্রকার মাদকদ্রব্য ব্যবহার হতে বিরত থাকুন। তাস খেলার অভ্যাস থাকলে অন্তত এক বছরের জন্য ভুলে থাকুন।
৮.. পোশাকপরিচ্ছদ থেকে শুরু করে প্রতিটি পদক্ষেপে পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে শেভ করে নিতে ভুলবেন না। বিশেষ করে মাস্টার প্যারেডে পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন।
৯.প্রতিবার পিটি প্যারেড করার পর ( দিনে ৩ বার) আন্ডারওয়ার চেঞ্জ করবেন (সাথেসাথে আপনার ব্যাটম্যান সব ধুয়ে রাখবে অবশ্য)। ঢাকা থেকে ভাল ব্রাণ্ডের আন্ডারওয়ার ( মেয়েদের ক্ষেত্রে সকল আন্ডারগার্মেন্টস)কমপক্ষে ৮/১০ টা করে অবশ্যই নিয়ে যাবেন। কারন সারদায় বা রাজশাহীতে ভালমানের আন্ডারগার্মেন্টস কিনতে পাওয়া যায় না ( দয়া করে রাজশাহীর কেউ মনে কষ্ট নিবেন না, আমার যা মনে হয়েছে, সেটাই বললাম) আপনি অন্য পোশাক যত কমদামীই পরেন, আন্ডারগার্মেন্টস অবশ্যই ভাল,দামী এবং ব্রান্ডের হতে হবে।
বুট যথাযথ সাইজের ব্যবহার করবেন। মোজা পরিষ্কার রাখার বিষয়ে যত্নবান হোন। প্যারেড করার জন্য বাইরে থেকে বানানো ইউনিফরম ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। সেগুলোকে বরং ক্লাস ও মাস্টার প্যারেডে ব্যবহার করুন। বিপিএ বাজারে অনেক কম দামে ( ২৫০-৩০০) প্যারেডের ইউনিফরম পাওয়া যায়। প্যারেডের সময় ভিতরে স্যান্ডো গেঞ্জি ব্যবহার না করে হাফ হাতা গেঞ্জি ( নানা গেঞ্জি) ব্যবহার করবেন। সেক্ষেত্রে আপনার বাহুর জয়েন্টে ইউনিফরম এর কঠিন কাপড়ের ঘর্ষনে ক্ষত হয়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে বাচবেন।
১০. ট্রেনিং এর সবকিছু স্পোর্টিংলি নিন। খুব সিরিয়াসলি নিলে বা কষ্টকর কাজ মনে করলে এই ১ বছর আপনার কাছে ১০ বছরের সমান মনে হতে পারে। ক্লাসে বা মাঠে ফোন নিয়ে যাবেন না ( ধরা পড়লে জামিন নাই)
১১. আপনার সাথে যে নারী সহকর্মীবৃন্দ ট্রেনিং করছেন, তাদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুন। তাদের অসম্মান হয়, এমন কথা, কাজ হতে বিরত থাকুন। তাদেরকে বোনের দৃষ্টি তে দেখবেন। দৃষ্টিকটু কোন কর্মকাণ্ডে যদি জড়িয়ে পড়েন, জেনে রাখবেন কঠোর, নির্মম পরিণামই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
১২. আপনি এখন বাংলাদেশ পুলিশ পরিবারের গর্বিত সদস্য। কথায়, কাজে, আচরনে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, এমন কিছু করা হতে বিরত থাকবেন। পুলিশকে ওউন করুন।
১৩. সবশেষে বলব, একবছর মেয়াদী ট্রেনিং করতে এসেছেন,আপনি সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে একদিন ট্রেনিং শেষ হবে। তাই স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সবসময় সতর্ক থাকবেন। এমন কিছু করা যাবে না, যাতে মারাত্মক কোন ইনজুরিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। অযথা রিস্ক এড়িয়ে চলবেন। রোদের মধ্যে প্যারেড হওয়ার কারনে ক্রমাগত ঘাম নিঃসরণ হবে।। তাই সুস্থ থাকতে সকাল বিকাল স্যালাইন খেতে ভুলবেন না। পরিমিত খাবার ( ভাত ও রুটি) গ্রহণ করুন। এতে আপনার শরীরের বাড়তি মেদ ঝরানো সহজ হবে।প্রচুর ফল ও পানি খাবেন ( বিপিএ বাজারে অনেক মৌসুমি ফল পাওয়া যায়। ব্যাটম্যানকে দিয়ে আনিয়ে নিন)।
মনে রাখবেন, এখানে যা কিছু হবে, সব আপনার ভালর জন্যই করা হবে। আপনাকে একজন সুশৃঙ্খল, পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, জ্ঞানসম্পন্ন, যুগোপযোগী, শারীরিক ভাবে সক্ষম পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই এখানকার সকল আয়োজন । একবছর পরিশ্রম করুন, বাকিজীবন সেই পরিশ্রমের ইতিবাচক ফল ভোগ করতে পারবেন। আশা করি, আপনাদের এই একটি বছর খুব ভাল কাটবে। সবার সুস্থ ও সুন্দর জীবন এবং সফল ট্রেনিং প্রত্যাশা করছি।
…………………………………………..
Shamim Anwar,
এএসপি, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ
৩৪ তম বিসিএস, ১১ তম মেধাস্থান।
…………………………………………….